সঙ্গীতকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন- শিল্পী কামাল আহমেদ | গণযোগ

বাংলাদেশ বেতারের সাবেক উপ-মহাপরিচালক (অনুষ্ঠান) কর্মকর্তা শিল্পী কামাল আহমেদ। দীর্ঘদিন ধরে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চা কাজ করছেন। সরকারের উঁচু পদে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তিনি নিরবধি গান নিয়ে কাজ করে গেছেন। তার বেশ কিছু একক ও যৌথ গানের এ্যালবাম বের হয়েছে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন সম্মান এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পুরষ্কার। গান নিয়ে নিজের, স্বপ্ন সন্তুষ্টি ও পরিকল্পনা বিষয়ে প্রতিশ্রুতিশীল এই শিল্পী সম্প্রতি কথা বলেছেন গণযোগের সাথে…

গণযোগ: আপনার শিক্ষাজীবনের বিস্তারিত জানতে চাই।
কামাল আহমেদ: আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় খোঁকড়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ৬ষ্ট শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত বাঁশেরবাদা বহুমুখি উচ্চবিদ্যালয়। নবম ও দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়ন করি টেবুনিয়া ওয়াসিম পাঠশালায়। এরপর পাবনা শহরে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে পড়ালেখা করি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়ালেখা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে। সেখানেই বিএসসি (অনার্স) এবং এমএসসি ডিগ্রি লাভ করি।

গণযোগ: ছাত্রজীবন থেকেইতো সংগীতচর্চা করেন। ঠিক কোন বয়স থেকে গানে সিরিয়াস হলেন?
কামাল আহমেদ: স্কুল জীবন নবম/দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই সঙ্গীত সিরিয়াস হলাম। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ছায়ানটের মাধ্যমে।

গণযোগ: যখন সরকারি চাকুরীজীবি ছিলেন তখন সরকারি দায়িত্ব পালন এবং সংগীত সাধনা দুটি ব্যালেন্স করতেন কিভাবে?
কামাল আহমেদ: সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে

গণযোগ: আপনি রবীন্দ্রনাথের গানের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে অনেক মৌলিক গান করে থাকেন। বিভিন্ন বিষয়ে গান করার চিন্তা করলেন কেন?
কামাল আহমেদ: একজন শিল্পীকে সার্বজনীন হতে এবং সকল শ্রোতার কাছে পৌছাতে গেলে সব ধরনের গান করা উচিত। এই ভাবনা থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশিপাশি অন্য গান করা ভাবনা আসে।

গণযোগ: আপনি বাংলাদেশ বেতারের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (প্রোগ্রাম) এর দায়িত্ব পালন করে সরকারি চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করার দীর্ঘ এসময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে জানতে চাই?
কামাল আহমেদ: বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনে চাকরি করার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, কবি সাহিত্যিক ও গুনীশিল্পীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছি। এরই মাধ্যমে সমগ্র চাকরি জীবনে আমাদের জীবন দর্শন, দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির লালন প্রসারে কাজ করার জন্য নিজেকে প্রাণিত করবার চেষ্টা করেছি।

গণযোগ: আমাদের দেশের সংগীতাঙ্গনে অনেক সমস্যা। আপনার দৃষ্টিতে এর কারণ কি?
কামাল আহমেদ: এর মূল কারণ সঙ্গীতে সামাজিক পরিবর্তনের ফলে শেখার চেয়ে গাইবার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। প্রত্যেককে আগে শেখা তারপর গাওয়া উচিত। তাছাড়া সঙ্গীত শেখায় সামাজিকভাবে সঙ্গীতের মর্যাদা দিন দিন হ্রাস পাওয়ায় অভিভাবকগণও তাদের সন্তানদের সঙ্গীত শিক্ষা দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

গণযোগ: সে ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তোরণের উপায় কি হতে পারে?
কামাল আহমেদ: সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সঙ্গীতকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরী সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

কামাল আহমেদ_বইমেলায় গান পরিবেশনরত
অমর একুশে বইমেলায় সংগীত পরিবেশন করছেন কামাল আহমেদ

গণযোগ: কণ্ঠের যত্ন নেওয়ার জন্য একজন কণ্ঠশিল্পীকে কোন বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
কামাল আহমেদ: প্রতিদিন নিয়মিত রেওয়াজ করা এবং যে কোনো একজন গুরুর সান্নিধ্যে থাকা।

গণযোগ: রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী নাকি আধুনিক গানের শিল্পী? কোনটায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
কামাল আহমেদ: রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী।

গণযোগ: সংগীত নিয়ে আপনার স্মরণীয় কোন ঘটনা বলুন।
কামাল আহমেদ: আমি বেশ কয়েকবার তারা টেলিভিশন “আজ সকালের আমন্ত্রণে” অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। এর মধ্যে একবার একটি গান স্বাগতা লক্ষী দাস গুপ্ত খুবই পছন্দ করেছিলেন। গানটি ছিল “নিশি না পোহাতে”। একটি অন্তরার অসাধারণ প্রেমের গান। স্বাগতা লক্ষ্মী দাস গুপ্তকে রবীন্দ্র বিস্ময় বলা হয়। কারণ মাত্র ৯০ দিনে তিনি রবীন্দ্রনাথের সকল গান রেকর্ড করেছিলেন। এ বিষয়টি আমি জানতে পারি পরের দিন।

ঠিক তার পরের দিনে কলকাতা একটি অনুষ্ঠানে আমি ও স্বাগতা লক্ষী দাশগুপ্ত গান করি। যেহেতু আমি স্বাগতা লক্ষী দাশগুপ্তের কনিষ্ঠ এ কারণেই আমি আগে পরপর পাঁচটি গান গাইলাম। গান শুনে দাশগুপ্ত মঞ্চের পাশে এগিয়ে যান এবং আমি যখন মঞ্চ থেকে নামি আমাকে বলেন অনেকদিন পর আমি একজন শিক্ষিত মানুষের রবীন্দ্র সংগীত শুনলাম। আমি আপনার গান খুবই পছন্দ করি। গতকাল আপনি আজ সকালের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানে “নিশি না পোহাতে” যে গানটি করেছেন সেই গানটি আমি এবং আমার ছাত্ররা খুবই পছন্দ করেছে।

উল্লেখ্য আমি কলকাতায় থাকা অবস্থায় দুই দিন পর এই গানটি দাশগুপ্ত ছাত্রদের শিখিয়ে দেন এবং টেলিফোনের মাধ্যমে জানান। সংগীত জীবনের এটিই আমার সবচেয়ে বড় বা স্মরণীয় ঘটনা।

গণযোগ: আমরা জানি একজন সংগীতশিল্পী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে ডিজিটাল সকল প্ল্যাটফর্মে আপনার পদচারণা আছে। একজন সংগীতশিল্পীকে ডিজিটাল মাধ্যমে নিজের অবস্থান শক্ত করতে কতোটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
কামাল আহমেদ: বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যুগে একজন শিল্পীকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত তার সকল সৃষ্টি ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া।

গণযোগ: আপনি সবসময় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এক ধাপ এগিয়ে পথ চলার চেষ্টা করেন। যার প্রতিফলন আমরা ডিজিটালি দেখতে পাই। আপনার একটি ডিজিটাল আর্কাইভও আছে। সেটি নিয়ে কিছু বলুন?
কামাল আহমেদ: আমি আমার জীবনের শুরু থেকেই সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী করেছি। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সঙ্গীতের সকল সৃষ্টি আমি গবেষণা এবং পরিকল্পনার মাধ্যমেই করেছি। আমার সমগ্র জীবনের সৃষ্টি বিশ্ববাসীর কাছে এই ডিজিটাল আর্কাইভের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পেরে আমি আনন্দিত। এ জন্য এই ডিজিটাল আর্কাইভ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ভার্সডসফট লিঃ‘ এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

👉 সংগীতশিল্পী কামাল আহমেদের ডিজিটাল আর্কাইভ এর যাত্রা শুরু | দৈনিক যুগান্তর

গণযোগ: আপনার বর্তমান ব্যস্ততা কি নিয়ে?
কামাল আহমেদ: আমার বর্তমান ব্যস্ততা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে।

গণযোগ: আপনার গানের অ্যালবাম বা সিডি কতটি?
কামাল আহমেদ: আমার মোট ৩১টি এ্যালবাম বেরিয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে।

গণযোগ: এ পর্যন্ত আপনি কতগুলো পুরস্কার অর্জন করেছেন?
কামাল আহমেদ: আমি ১১টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছি।

গণযোগ: সংগীত নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা কি?
কামাল আহমেদ: আমার আগামীতে সঙ্গীত নিয়ে আগামীতে অডিও ভিডিও প্রযোজনা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরী করার পরিকল্পনা রয়েছে এবং এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সঙ্গীত বিষয়ে গবেষণা হবে। এছাড়া দেশের নান প্রান্তের সকল যোগ্য শিল্পীদের সঙ্গীত প্রতিভা বিকাশে নানা আঙ্গিকে সহযোগিতা প্রদান করা হবে।

সূত্র: গণযোগ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top